সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর ভাঙনে কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি। সর্বশেষ গত বুধবার নতুন করে দেবে গেছে একটি সেতু, ভেঙে পড়েছে রাস্তা। নদীভাঙনের কারণে হুমকিতে আছে আরও ৮ থেকে ১০টি বসতভিটা। নদীভাঙন ঠেকাতে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বিস্তীর্ণ জনপদসহ অনেক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসী।
স্থানীয় লোকজন জানান, এক যুগ ধরে উপজেলার পূর্ব পৈলনপুর ইউনিয়নের কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী ফাজিলপুর গ্রামের পাশের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ব্যাপক নদীভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। ৩ থেকে ৪ বছরে নদীভাঙনের কারণে পৈলনপুর ও ফাজিলপুর গ্রামের অন্তত ২০টি ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। সর্বশেষ বুধবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত পৈলনপুর ও ফাজিলপুর গ্রামের মধ্যবর্তী অংশটি নদীভাঙনের কবলে পড়ে। এতে ওই অংশের অন্তত ৩০০ মিটার রাস্তা ভেঙে গেছে এবং সেখানে থাকা একটি সেতু পুরোপুরি দেবে গেছে। ভাঙনের তীব্রতায় ভেঙে পড়া রাস্তার ওই অংশে ৫ থেকে ৮ ফুট গভীর হয়ে পড়েছে।
গতকাল শনিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, কুশিয়ারা নদীর ঠিক পাড় ঘেঁষেই শেরপুর-বালাগঞ্জ রাস্তার অবস্থান। ফাজিলপুর গ্রামের পাশেই রাস্তাটি নদীভাঙনে দেবে গেছে। ভাঙনের শিকার রাস্তার ওই অংশে থাকা সেতুটি নদীর দিকে হেলে পড়েছে। রাস্তা দেবে বিশাল গর্ত তৈরি হওয়ায় শেরপুর ও বালাগঞ্জ অংশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
ফাজিলপুর গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আমিন (৩৫) পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। তিনি জানান, সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এতে দুই দফা গাড়ি বদলাতে হচ্ছে যাত্রীদের। এ কারণে বিশেষ করে যাঁরা মালামাল পরিবহন করছেন, তাঁদের দুর্ভোগ বেড়েছে। এ ছাড়া নদীভাঙনের তীব্রতা বেশি হওয়ায় স্থানীয় মানুষজন বাড়িঘর, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
শেরপুর-বালাগঞ্জ সড়ক দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে যাত্রী পরিবহন করে ফাজিলপুর গ্রামের কিশোর সানি মিয়া (১৭)। সে জানায়, সড়ক দিয়ে আশপাশের অর্ধশতাধিক গ্রামের বাসিন্দা প্রতিদিন চলাচল করেন। এ ছাড়া গড়ে কয়েক শ যানবাহন এ সড়কে যাত্রী পরিবহন করে থাকে। রাস্তা ভেঙে পড়ায় যানবাহনের চলাচল কমেছে।
এলাকাবাসী জানান, নদীভাঙনে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় শেরপুর থেকে আসা যানবাহন ফাজিলপুর গ্রামের পাশে গিয়ে থামছে। সেখানে গাড়ি থেকে নেমে যাত্রীরা একটু দূরে থাকা খেতের জমি দিয়ে খানিকটা হেঁটে পৈলনপুর গ্রামের পাশে যান। পরে সেখানে যাত্রী পরিবহনের কাজে থাকা অন্য যানবাহনে চড়ে বালাগঞ্জ উপজেলা সদরসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে যাচ্ছেন। ভাঙনে রাস্তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় দুই দফা যাত্রীদের গাড়ি বদলাতে হচ্ছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে।
ফাজিলপুর গ্রামের ইব্রাহিম মিয়া (২৯) বলেন, নদীভাঙনের শিকার এলাকা ফাজিলপুর থেকে বালাগঞ্জ উপজেলা প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে। এ ছাড়া শেরপুর থেকে ফাজিলপুরের দূরত্বও প্রায় ১১ কিলোমিটার। গণ-অভ্যুত্থানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নদী থেকে একটি প্রভাবশালী মহল বালু উত্তোলন করায় ফাজিলপুর এলাকা তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে। তবে স্থায়ীভাবে ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বাড়িঘরের সঙ্গে নদীভাঙনে গাছপালাও বিলীন হয়ে গেছে। বহু পরিবার সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে।
পৈলনপুর অংশে যেখানটায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে, এর ঠিক পাশেই ওয়ার্কশপের কর্মচারী কামরুল ইসলামের (২৭) বাড়ি। তিনি জানান, তাঁর বাড়ির ৮ শতক অংশে তিনটি বসতভিটা আছে। তাঁরাও এখন ভাঙনের ঝুঁকিতে আছেন। এক বছর আগে তাঁর ফুফু আয়েশা খাতুনের বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় তাঁদের জায়গায় ঘর তৈরি করেন। এখন তাঁরা আবারও ভাঙনের ঝুঁকিতে আছেন। কখন ঘর ভেঙে যায়, সে আতঙ্কে রাত জেগে থাকেন।
কুশিয়ারা নদীর ঠিক পাড়েই মালদ্বীপপ্রবাসী মো. বাবুল মিয়ার (২৮) বাড়ি। তিনি জানান, তাঁদের বসতভিটার ৪৫ শতাংশ জায়গার মধ্যে ভাঙতে ভাঙতে এখন ১৫ শতাংশ অবশিষ্ট আছে। ৩ থেকে ৪ বছর ধরে নদী ক্রমাগত ভাঙছে। এ সময়ের মধ্যে ভাঙনের কবলে পড়ে তাঁদের তিনবার নতুনভাবে ঘর তৈরি করতে হয়েছে। আবার ভাঙনের ঝুঁকিতে আছেন। এখন তাঁদের ঘর ভেঙে গেলে পুরোপুরি আশ্রয়হীন হয়ে পড়বেন। তাই ব্লক ফেলে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানিয়েছেন।
যোগাযোগ করলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, নদীভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলে জরুরি সংস্কারকাজের জন্য তিনবার ঠিকাদার নিয়োগে চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে হয়েছে। কারণ, জিও ব্যাগ প্রস্তুতে বালুর অপ্রতুলতায় ঠিকাদার ব্যর্থ হন। এখন পুনরায় জরুরিভাবে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে ঠিকাদার নিয়োগে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সিলেটে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার তিনি ভাঙনের শিকার রাস্তাটি সরেজমিনে দেখে এসেছেন। পাউবো নদীভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেবে। অন্যদিকে এলজিইডি দ্রুততার সঙ্গে জরুরিভাবে রাস্তাটি সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চেয়ে লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে।
এদিকে গতকাল শনিবার বিকেলে ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী। এ সময় তিনি ভাঙনপ্রবণ এলাকায় বসবাসকারী ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি স্থানান্তরের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি দ্রুততার সঙ্গে রাস্তা নির্মাণ ও নদীভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিও উত্থাপন করেন।
মন্তব্য করুন